

নিজস্ব প্রতিবেদক: মিষ্টি যখন শুধু স্বাদের বিষয় নয়, হয়ে ওঠে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর এক জনপদের আত্মপরিচয়ের বাহক—তখন সে মিষ্টির গুরুত্ব আর সাধারণ থাকে না। ঠিক তেমনি এক মিষ্টান্ন হচ্ছে “পাতক্ষীর”—যা শতাব্দীর স্বাদ আর ঐতিহ্য নিয়ে আজও জেগে আছে মুন্সীগঞ্জে।
কলাপাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয় বলে এর নাম ‘পাতক্ষীর’। যদিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষীরসা নামক মিষ্টি পাওয়া যায়, পাতক্ষীরের স্বাদ-গন্ধ, তৈরি প্রক্রিয়া এবং পরিবেশনার ভিন্নতা একে এনে দিয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্যের মর্যাদা। এটি শুধু একটি খাবার নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্মান্তরে বাঙালির রসনাবিলাসের নির্ভরযোগ্য অংশ হয়ে আছে।
ঐতিহ্যের জন্মসূত্র
লিপিবদ্ধ ইতিহাস না থাকলেও লোকমুখে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামে প্রায় ২০০ বছর আগে পাতক্ষীর তৈরির শুরু। পুলিনবিহারী দেব প্রথম এই মিষ্টির উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে ইন্দ্রমোহন ঘোষ এবং লক্ষ্মীরানী ঘোষসহ আরও কয়েকটি পরিবার এই কৌশলে যুক্ত হন। আজ তাঁদের উত্তরসূরিরা—কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীলচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ—এ ঐতিহ্যকে আগলে রেখেছেন। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, এই মিষ্টির তৈরি কৌশল শুধুমাত্র পরিবারের পুত্রবধূদের শেখানো হয়—মেয়েদের নয়, যেন গোপন রেসিপি বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে।
ইতিহাসের পাতায় পাতক্ষীর
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত সৈয়দ মুর্তজা আলীর “আমাদের কালের কথা” গ্রন্থে পাতক্ষীরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে ঢাকার রাস্তায় ফেরিওয়ালাদের কলাপাতায় মোড়ানো পাতক্ষীর বিক্রির স্মৃতি তিনি রোমন্থন করেছেন। এছাড়াও “ও কলকাতা শারদীয়া ১৪২৯” এবং “আত্মজীবন: ভাই গিরিশচন্দ্র সেন” বইতেও এই মিষ্টির উল্লেখ রয়েছে, যা পাতক্ষীরের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক পথচলার সাক্ষ্য বহন করে।
স্বাদের রহস্য
পাতক্ষীর তৈরিতে মূলত দুধ, সামান্য চিনি ও এক চিমটি হলুদ ব্যবহার করা হয়। দেখতে হালকা হলুদাভ, চ্যাপ্টা ও গোলাকার এই মিষ্টি তৈরি করতে ৩০ লিটার দুধে মাত্র ৫ কেজি পাতক্ষীর পাওয়া যায়। কলাপাতায় মোড়ানো প্রতিটি পাতায় থাকে প্রায় ৫০০ গ্রাম। এর স্বাদের মূল রহস্য—স্থানীয় গাভীর দুধ, অভিজ্ঞ কারিগরের হাতের ছোঁয়া, এবং মাটির চুলায় দীর্ঘসময় ধরে জ্বাল দেওয়ার প্রক্রিয়া।
এক জেলার স্বাদ, সারা দেশের গর্ব
বর্তমানে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় ১৭টি দোকানে পাতক্ষীর তৈরি ও বিক্রি হয়। গ্রীষ্মকালে দৈনিক ৪০-৫০ পাতা বিক্রি হলেও শীতকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০০-২৫০ পাতায়। কারণ শীতের পিঠা-পুলির সঙ্গে পাতক্ষীর যেন অবিচ্ছেদ্য। পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি কিংবা মুখশোলাতে পাতক্ষীরের ব্যবহার একে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। নতুন জামাইয়ের সামনে পাতক্ষীর ছাড়া পিঠা পরিবেশনের কথা কল্পনাই করা যায় না।
সিরাজদিখান বাজারে প্রতিদিন প্রায় ২০০ মণ দুধ কেনাবেচা হয়, যার বড় অংশ যায় পাতক্ষীর তৈরিতে। অন্য জেলার ক্ষীরসার তুলনায় পাতক্ষীরের স্বাদ একেবারে আলাদা—যার পেছনে রয়েছে স্থানীয় দুধের গুণমান এবং দক্ষ কারিগরদের অভিজ্ঞতা।
বিশ্ব দরবারে পাতক্ষীর
পাতক্ষীর এখন আর শুধু মুন্সীগঞ্জের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে এই মিষ্টান্ন পৌঁছে যাচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যদিও পরিবহন এবং সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে বাণিজ্যিকভাবে এর রপ্তানি এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে, তবুও এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
সরকারিভাবে সহায়তার দাবি
রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মা ক্ষীর ভাণ্ডারসহ স্থানীয় দোকানগুলো পাতক্ষীর তৈরিতে নিয়োজিত। কিছু উদ্যোক্তা এখন অনলাইনেও এর বিপণনে কাজ করছেন। স্থানীয়দের মতে, সরকারিভাবে উপযুক্ত সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে এই জিআই পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও সুনাম কুড়াতে পারবে।
মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, “পাতক্ষীর মুন্সীগঞ্জের একটি অনন্য ঐতিহ্য। এর স্বাদ যেমন অসাধারণ, তেমনি উপাদানও স্বাস্থ্যসম্মত। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে সরকার ও সমাজকে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশি-বিদেশি প্রচারের মাধ্যমে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও সহায়ক হবে।”
মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর কেবল একটি মিষ্টি নয়, এটি এক জেলার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও স্বকীয়তার পরিচায়ক। ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি এই ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রথম ধাপ। এখন প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, আধুনিক সংরক্ষণ ও পরিবহন প্রযুক্তির সমন্বয়—যাতে শতাব্দী পেরিয়ে আসা এই স্বাদের যাত্রা হয় আরও বিস্তৃত, আরও গর্বের।